বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের বুকের দুধই হচ্ছে নবজাতকের জন্য আদর্শ পুষ্টিকর খাবার। এতে সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণ যেমন থাকে না তেমনি মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুর সঠিকভাবে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে। মায়ের দুধে অন্তত ২০০ উপাদান রয়েছে, যার প্রতিটিই শিশুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যা অন্য কোনো খাবারে কিংবা প্যাকেটের দুধে নেই।
ব্রেস্টফিডিং বা বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে মায়েদের স্তন এবং ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকিও কমে। মাতৃদুগ্ধ পানের মধ্য দিয়ে সন্তান এবং মায়ের মধ্যে তৈরি হয় এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, শিশু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে নবজাতক মৃত্যুর হার ২২ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
কিভাবে শুরু করবেন
নবজাতককে ব্রেস্টফিডিং বা বুকের দুধ খাওয়া শুরু করার সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত হচ্ছে প্রথমবার যখন আপনি বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলেন। বাচ্চার পুরো শরীরকে আলতো করে আপনার দিকে ঘুরিয়ে নিন এবং বাচ্চাকে বুকের কাছে টেনে নিন। আপনার নিপলে বাচ্চার ঠোঁট লাগিয়ে দিন এবং যখন সে মুখ খুলবে তখন আস্তে করে আপনার নিপল বাচ্চার মুখে ঢুকিয়ে দিন ও চেপে ধরুন।
শুরুতে খুব সামান্য পরিমাণে বুকের দুধ তৈরী হয়। একে শাল দুধ বলা হয় যা শিশুকে বিভিন্ন সংক্রমন থেকে রক্ষা করে।
যদি বাচ্চা মুখ না খোলে কিংবা নিপল মুখে না রাখতে পারে তাহলে ভয়ের কিছু নেই। ব্রেস্টফিডিং করতে অনেক ধৈয্য এবং অনুশীলন করতে হয়। আপনি যদি হাসপাতালে বা ক্লিনিকে থাকেন তাহলে এই ব্যাপারে দক্ষ নার্সের সাহায্য নিতে পারেন।
আপনার শিশু যদি প্রিম্যাচিউর হয় তাহলে শিশু নিজে থেকে বুকের দুধ খেতে পারবে না। এক্ষেত্রে পাম্প করে বুকের তাকে দুধ খাওয়াতে হবে।
দিনে সর্বোচ্চ কতবার ব্রেস্টফিডিং করাবেন
আপনি যত বেশি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন আপনার তত বেশি দুধ তৈরী হবে। দিনে অন্তত ৮-১২ বার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে যেতে পারে। শিশুকে অবশ্যই ৪ ঘন্টা পরপর বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। যদি সে ঘুমিয়ে থাকে তাহলে আস্তে আস্তে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাওয়াতে হবে। অনেক সময় বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়ও ছোট বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ঘুম থেকে জেগে উঠলে আবার খাওয়ানো শুরু করতে পারেন।
ব্রেস্টফিডিং এর সময় মায়ের প্রয়োজনীয় খাবার
সুষম ও পুস্টিকর খাবার মায়ের বুকের দুধ তৈরীতে ভুমিকা রাখে। অনেকই ওজন কমানোর জন্য ডায়েটিং করেন যার ফলে শিশু ঠিকমত বুকের দুধ পায় না এবং অপুস্টিতে ভুগতে শুরু করে। এক্ষেত্রে একসঙ্গে অতিরিক্ত না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খান। ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল গ্রহনে বিরত থাকুন।
ব্রেস্টফিডিং এর সুফল
শিশুর জন্য সুফল
- ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুস্টি এবং শক্তি মায়ের বুকের দুধ থেকে পাওয়া যায়। এতে করে শিশুর শরীরিক এবং মানসিক বিকাশ সঠিকভাবে হয়।
- বুকের দুধ খুব সহজে হজম হয় এবং তা অ্যালার্জি মুক্ত।
- ছয় মাস বয়সের নিচে বুকের বাচ্চার জন্য দুধই একমাত্র নিরাপদ খাদ্য। বুকের দুধে প্রচুর পরিমানে পানি থাকে তাই আলাদা করে পানি খাওয়ানোর দরকার হয় না।
- মস্তিস্কের স্বাভাবিক গঠন ও মানসিক বিকাশে বুকের দুধ উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখে।
- মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধন আরো মজবুত হয়।
মায়ের জন্য সুফল:
- ব্রেস্টফিডিং সাধারনত প্রসবের পর মায়ের রক্তক্ষরনের পরিমান কমিয়ে দিয়ে থাকে।
- শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে আলাদাভাবে আর জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না।
- শিশুকে নিয়মিত বুকের দুধ খাওয়ালে মায়ের স্তন, জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
- শেষ বয়সে অস্টিওপোরেসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগ হওয়ার ঝুঁকিও ব্রেস্টফিডিং এর ফলে কমে যায়।
- ব্রেস্টফিডিং এর জন্য প্রচুর ক্যালরীর প্রয়োজন হয় তাই ব্রেস্টফিডিং করালে অতিরিক্ত ওজন কমে যায়।
কিভাবে বুকের দুধ পাম্প করবেন?
হাত দিয়ে বুকের দুধ পাম্প করা যায়। প্রথমে মাকে ব্রেস্টের নিপলের উপরের অংশে তার বৃদ্ধাঙ্গুল এবং নিচের অংশে বাকি চারটি আঙ্গুল রাখতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। বৃদ্ধাঙ্গুল এবং তর্জনী দিয়ে নিপলের উপরের অংশে এবং নিচের অংশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হালকা চাপ প্রয়োগ করুন। নিপলের মধ্যে চাপ প্রয়োগ করবেন না। সাধারনত প্রথম দিকে বুকের দুধ নাও আসতে পারে কিন্তু ধীরে ধীরে তা আসবে।
শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর পূর্বে অবশ্যই ভালকরে হাত ধুয়ে নিন এবং একবারে শিশু যতটুকু খেতে পারবে ততটুকু সরাসরি কিংবা একটি পাত্রে ঢেলে আস্তে আস্তে খাওয়ান। বুকের দুধ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ৬-৮ ঘন্টা পর্যন্ত রাখা যায় এবং রেফ্রিজারেটরে ৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রেখে ২ থেকে ৩ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এই ক্ষেত্রে দুধ খাওয়ানোর পূর্বে গরম পানির পাত্রে রেখে হালকা গরম করে নিতে হবে।
বিশেষ ক্ষেত্রে ব্রেস্টফিডিং করানো
কিছু কিছু মায়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে বুকের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না এই ক্ষেত্রে মাকে সঠিক ভাবে ব্রেস্টফিডিং করানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে কারন যত বেশী শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন আপনার শরীরে তত বেশী দুধ তৈরী হবে।
প্রসূতি মায়ের যদি কখনও ডায়াবেটিস, পলিসিসটিক ওভারি সিনড্রম কিংবা ব্রেস্ট বা নিপলের সার্জারি হয়ে থাকে তাহলে বুকের দুধ কম হতে পারে। মা যদি HIV কিংবা টিবিতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে ব্রেস্টফিডিং এর পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
শিশু কিংবা মা ও শিশু দুজনে যদি চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে ব্রেস্টফিডিং করাতে পারবে কিন্তু যদি শুধুমাত্র মা আক্রান্ত হন তাহলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত শিশুর কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং পাম্প করে তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবে। হেপাটাইটিস এ, বি এবং সি তে আক্রান্ত মা শিশুকে সরাসরি ব্রেস্টফিডিং করাতে পারবে। ব্রেস্টফিডিং করালে মাকে অবশ্যই ধূমপান এবং অ্যালকোহল ত্যাগ করতে হবে কারণ এগুলো শিশু জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শিশু ও মায়ের আশেপাশে কখনও ধূমপান করা উচিত নয়। শিশুর যদি গ্যালাক্টোসোমিয়া (এক ধরনের দূর্লভ জিনগত সমস্যা যার ফলে শিশুর শরীর গ্যালাক্টোসকে গ্লুকোজে রূপান্তর করতে পারে না এবং এর ফলে শক্তি উৎপন্ন হয় না। গ্যালাক্টোস দুধ ও দুধের তৈরী খাবারের মধ্যে পাওয়া যায়) থাকে তাহলে শিশুকে ব্রেস্টফিডিং করানোর পরিবর্তে ল্যাক্টোসবিহীন দুধ খাওয়াতে হবে। অসুস্থ শিশুকে বারবার বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত।
কর্মজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে:
যদি কর্মক্ষেত্রে ব্রেস্টফিডিং এর সুব্যবস্থা থাকে তাহলে শিশুকে সাথে নিয়ে যেতে পারেন অথবা বুকের দুধ পাম্প করে রেখে যেতে পারেন যাতে করে আপনার অনুপস্থিতিতে পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারে। তবে বাসায় আসার পর শিশুকে অবশ্যই বুকের দুধ সরাসরি খাওয়াতে হবে।