সপ্তাহ – ৩০

এই সপ্তাহে আপনার শরীর এবং আপনার শিশুর শরীর আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আপনার শিশুর শরীর ক্রমাগত বড় হচ্ছে, এবং তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আরও উন্নত হচ্ছে। আপনি এখন আরও বেশি শারীরিক পরিবর্তন অনুভব করতে পারেন, যেমন পেটে টান বা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্লান্তি। কিন্তু চিন্তা করবেন না, এগুলো সবই স্বাভাবিক, এবং আপনার শিশুর ক্রমবর্ধমান বিকাশের একটি অঙ্গ।

শিশুর বিকাশ

  • আকার ও ওজন: আপনার শিশুর আকার এখন প্রায় ৪৩ সেন্টিমিটার এবং তার ওজন ১.৭ কেজি থেকে ২ কেজি হতে পারে। এটি এখনও দ্রুত বাড়ছে, এবং তার শরীরে বেশি চর্বি জমছে। এই সময় শিশুর ত্বক আরও মসৃণ হতে শুরু করছে, এবং তার শরীরের চর্বি তাকে শীত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
  • শ্বাসযন্ত্রের কার্যকারিতা: শিশুর শ্বাসযন্ত্রের উন্নতি ঘটছে, এবং তার ফুসফুস আরও শক্তিশালী হচ্ছে। যদিও শিশুর জন্মের আগে তার ফুসফুস পুরোপুরি পরিপূর্ণ হবে না, তবে এখন থেকে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। শিশুর শ্বাসযন্ত্রের সুরক্ষা পদার্থ (surfactant) এখন উৎপন্ন হচ্ছে, যা তাকে শ্বাস নিতে সাহায্য করবে।
  • অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিপূর্ণতা: শিশুর হাত-পা এখন সম্পূর্ণরূপে গঠিত এবং তার মস্তিষ্কও আরও সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠছে। শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে, এবং সে বিভিন্ন পরিবেশগত পরিবর্তন অনুভব করতে পারে, যেমন আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য। এখন সে নিজের হাত-পা নেড়ে সাড়া দিতে পারে।
  • চোখের উন্নতি: আপনার শিশুর চোখের রেটিনা (retina) এখন পুরোপুরি বিকশিত, এবং সে আলো এবং অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে সক্ষম। এই সময়, শিশুটি যখন আপনার সাথে কথা বলে, বা তার মায়ের স্পর্শ অনুভব করে, তখন তার স্নায়ুতন্ত্রের গতি আরও দ্রুত হয়।

গর্ভাবস্থার শারীরিক লক্ষণ

  • গর্ভের টান বা ব্যথা: এই সপ্তাহে অনেক মায়ের গর্ভে কিছুটা টান বা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এটি সাধারণত গর্ভাশয়ের প্রসারিত হওয়ার কারণে হয়। এছাড়াও, আপনার পেটের পেশীও প্রসারিত হচ্ছে, যা ব্যথার কারণ হতে পারে। তবে যদি ব্যথা তীব্র বা অস্বাভাবিক হয়, তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • কোমর ও পিঠে ব্যথা: গর্ভাবস্থার শেষের দিকে কোমর এবং পিঠে ব্যথা আরও তীব্র হতে পারে। শিশুর আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার শরীরের ভারসাম্যও পরিবর্তিত হয়, ফলে এই ব্যথা আরও বেশি অনুভূত হয়। হালকা যোগব্যায়াম বা পিলাটেস আপনার পিঠের ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
  • ঘন ঘন প্রস্রাবের অনুভূতি: আপনার গর্ভাশয়ের আকার আরও বড় হওয়ায় তা মূত্রথলির ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, ফলে ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসতে পারে। এটি সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষ দিকে একটি স্বাভাবিক সমস্যা। পর্যাপ্ত পানি পান করে এবং প্রয়োজনে বিশ্রাম নিয়ে এটি সামাল দিতে পারেন।
  • স্বাভাবিক ক্লান্তি: তৃতীয় ত্রৈমাসিকের এই সময়ে আপনার শরীরের উপর বাড়তি চাপ পড়ে, ফলে আপনি প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। এটি আপনার শরীরের রিজার্ভ শক্তির অভাবের কারণে হতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং আপনার খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন, যাতে আপনার শক্তি পুনরুদ্ধার হয়।

আপনার এবং শিশুর জন্য করণীয়

  1. গর্ভাবস্থার শেষ ধাপে প্রস্তুতি:
    • আপনার শিশুর জন্মের প্রস্তুতি এখন শেষের দিকে চলে এসেছে। তাই আপনার ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করুন এবং প্রসবের জন্য কিছু প্রস্তুতি নিন। শিশুর জন্য জামা-কাপড়, বিছানা, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি প্রস্তুত রাখুন।
    • শিশুর জন্মের পরিকল্পনা এবং প্রসবকক্ষে আপনার এবং আপনার সঙ্গীর ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জন্মের পরবর্তী যত্নের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
  2. পুষ্টির দিকে নজর দিন:
    • প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম: এই সময়ে শিশুর হাড় এবং পেশীর উন্নতির জন্য প্রোটিন এবং ক্যালসিয়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুধ, ডিম, মাছ, পনির, শাকসবজি ও মটরশুঁটি আপনার খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুন।
    • অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার যেমন টমেটো, তরমুজ, এবং বিভিন্ন ফলমূল আপনার শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী রাখবে।
  3. মনোযোগী বিশ্রাম ও প্রশান্তি:
    • শারীরিক পরিশ্রমের পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম এবং কিছুটা বিশ্রামের সময় আপনার শরীর এবং মনকে সতেজ রাখবে। এছাড়া ধ্যান এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করে মানসিক শান্তি বজায় রাখুন।
  4. হালকা ব্যায়াম করুন:
    • গর্ভাবস্থার এই সময়ে হালকা হাঁটা, যোগব্যায়াম বা পিলাটেসের মতো ব্যায়াম করা উপকারী। এতে আপনার শরীর নমনীয় থাকে, এবং প্রসবের সময় এটি আপনার সহায়ক হতে পারে।
  5. প্রস্রাবের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখুন:
    • গর্ভাবস্থায় মূত্রথলির ওপর চাপ কমাতে বেশিরভাগ সময় বসে প্রস্রাব করুন এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের শারীরিক অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখুন।

ডাক্তারের পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা

  • যদি আপনি অতিরিক্ত রক্তপাত বা অস্বাভাবিক স্রাব অনুভব করেন।
  • যদি পেটে তীব্র বা অস্বাভাবিক ব্যথা অনুভব হয়।
  • যদি আপনার পায়ের বা হাতের ফোলাভাব অত্যধিক হয়ে যায়।
  • যদি শ্বাসকষ্ট বা অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব হয়।

এটি গর্ভাবস্থার গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ, এবং আপনি এখন সন্তানের জন্মের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হচ্ছেন। সঠিক পরামর্শ এবং যত্নের মাধ্যমে আপনি এই সময়টি ভালোভাবে পার করতে পারবেন। আপনাকে শুভ কামনা!