অভিনন্দন! আপনি এখন গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকের শুরুতে চলে এসেছেন। এই সময়টি গর্ভধারণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলির একটি। আপনার শিশুর আকার বড় হচ্ছে এবং আরও অনেক শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। এখন থেকে শিশুর জন্য প্রস্তুতি আরও গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
শিশুর বিকাশ
- আকার ও ওজন: এই সপ্তাহে আপনার শিশুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪১ সেন্টিমিটার এবং তার ওজন ১.৪ কেজি থেকে ১.৬ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। শিশুর শরীরে আরও চর্বি জমছে, এবং তার আকার পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্কের মতো হতে শুরু করছে। তার শরীরের ত্বক আরও পুরু হয়ে উঠছে, এবং এটি তার শ্বাসযন্ত্রের কার্যকারিতা আরও উন্নত করছে।
- মস্তিষ্কের বিকাশ: শিশুর মস্তিষ্ক আরও জটিল হচ্ছে, এবং এর স্নায়ু ব্যবস্থার প্রক্রিয়া আরও উন্নত হচ্ছে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্নায়ু সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে, যা শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃৎপিণ্ডের গতি এবং পেশীর কাজকর্মে সহায়ক হবে।
- শ্বাসযন্ত্রের প্রস্তুতি: শিশুর শ্বাসযন্ত্রের উন্নতি ঘটে চলেছে। তার ফুসফুস আরও প্রস্তুত হচ্ছে, এবং এখন শিশুর শ্বাসযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ নিজস্বভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। শিশুর শ্বাসনালীতে কিছুটা সুরক্ষা পদার্থ জমা হতে থাকে, যা তাকে জন্মের পর শ্বাস নিতে সাহায্য করবে।
- চোখের পাতা এবং দৃষ্টি: শিশুর চোখের পাতা পুরোপুরি খুলে গেছে, এবং সে তার চারপাশের আলো এবং অন্ধকার বুঝতে পারে। যদিও তার দৃষ্টি এখনও পূর্ণভাবে উন্নত হয়নি, তবে তাকে এখন পৃথিবীর আলো, এবং তার মায়ের স্পর্শ অনুভব করা সম্ভব।
- অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রস্তুতি: শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (যেমন হাত-পা) এখন সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। সে হাত-পা নেড়ে চলাচল করতে পারে, এবং নিজের অবস্থানও পরিবর্তন করতে সক্ষম হতে শুরু করেছে।
গর্ভাবস্থার শারীরিক লক্ষণ
- কোমর ও পিঠে ব্যথা: গর্ভাবস্থার তৃতীয় ত্রৈমাসিকের এই পর্যায়ে আপনার কোমর ও পিঠে অতিরিক্ত চাপ অনুভূত হতে পারে। আপনার শিশুর আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তা আপনার পিঠ ও কোমরের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। আপনি যদি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকেন বা বসে থাকেন, এই ব্যথা আরও তীব্র হতে পারে। কিছু হালকা স্ট্রেচিং বা পিলট পজিশনে শোয়া আপনাকে সহায়তা করতে পারে।
- পায়ের ফোলাভাব: এই সপ্তাহে পায়ের ফোলাভাব বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি সাধারণত শারীরিক পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত চাপের কারণে হয়ে থাকে। পা উঁচু করে শোয়া, অতিরিক্ত পানি পান করা এবং হালকা ব্যায়াম করে ফোলাভাব কমানো সম্ভব।
- দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস: গর্ভধারণের শেষ পর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাসে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। আপনার শরীরে অতিরিক্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাপ অনুভূত হতে পারে, বিশেষত যখন শিশুটি আরও বড় হচ্ছে। তাছাড়া গর্ভাশয়ের আকার বাড়ানোর ফলে শ্বাসনালীতে আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এটি স্বাভাবিক, তবে গভীর শ্বাস নেওয়া এবং বিশ্রাম নিতে ভুলবেন না।
- প্রচণ্ড ক্লান্তি: গর্ভাবস্থার এই সময়ে আপনি অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। এটি আপনার শরীরের অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে হতে পারে। তাই আরও বেশি বিশ্রাম নেওয়া এবং শরীরের প্রতি সহনশীলতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের শক্তি ফিরিয়ে আনতে একটু বিশ্রাম এবং বিশুদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করুন।
আপনার এবং শিশুর জন্য করণীয়
- পুষ্টির দিকে মনোযোগ দিন:
- আয়রন ও ক্যালসিয়াম: গর্ভাবস্থার এই সময়ে আপনার শরীরে আয়রন এবং ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন বাড়তে থাকে। আয়রন রক্ত তৈরি করে এবং ক্যালসিয়াম শিশুর হাড় গঠনে সাহায্য করে। আপনার খাদ্যতালিকায় দুধ, পনির, ডাল, শিম, মাংস এবং সবুজ শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত করুন।
- ভিটামিন সি ও ফোলেট: ভিটামিন সি শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করবে, আর ফোলেট আপনার শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। সাইট্রাস ফল, টমেটো এবং অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার খান।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন:
- মৃদু হাঁটা বা যোগব্যায়াম: হাঁটা বা যোগব্যায়াম আপনার শরীরকে নমনীয় রাখবে এবং প্রসবের সময় আপনাকে সাহায্য করবে। যদি আপনি আরও উপকৃত হতে চান, তবে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামও করতে পারেন। এটি আপনার শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
- ম্যাসেজ: কোমর ও পিঠে ব্যথা কমাতে হালকা ম্যাসেজ নিতে পারেন। তবে খুব জোরালো ম্যাসেজ না করে নরমভাবে ম্যাসেজ করুন।
- আত্মবিশ্বাসী হন ও মানসিক শান্তি বজায় রাখুন:
- গর্ভাবস্থার শেষ সময়ে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ হতে পারে, তবে এটি আপনার শরীর এবং শিশুর জন্য ক্ষতিকর। তাই নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, নিজের পছন্দের কাজ করুন এবং প্রতিদিন কিছু সময় মানসিক শান্তির জন্য কাটান। গান শোনা, প্রিয় বই পড়া বা ধ্যান করা আপনাকে প্রশান্তি দেবে।
- পানি বেশি খান:
- গর্ভাবস্থায় শরীরে পানি কম থাকলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, যেমন পেটের সমস্যা, ফোলাভাব এবং ক্লান্তি। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করুন যাতে আপনার শরীর ও শিশুর শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে হাইড্রেটেড থাকে।
ডাক্তারের পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা
- যদি আপনি অতিরিক্ত রক্তপাত বা অস্বাভাবিক স্রাব অনুভব করেন।
- যদি আপনার পেটের তীব্র বা অস্বাভাবিক ব্যথা হয়।
- যদি আপনার পায়ে বা মুখে অতিরিক্ত ফোলাভাব দেখা দেয়।
- যদি আপনার শ্বাসকষ্ট বা অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব হয়।
এই সপ্তাহে আপনি গর্ভাবস্থার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে পৌঁছেছেন। আপনার শিশুর বিকাশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং আপনি তার জন্মের প্রস্তুতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যত্নশীল এবং শান্ত থাকুন, এবং আপনার শরীর ও মনের প্রতি যত্ন নিন। আগামী সপ্তাহে আরও কিছু নতুন পরিবর্তন দেখতে পাবেন, যা আপনার সন্তানের আরও উন্নতি ঘটাবে।